আজ বিশ্ব বন্ধু দিবস! জানুন এই বিশেষ দিনটির অজানা ইতিহাস


 রবিউল হোসেন: প্রতি বছর আগস্ট মাসের প্রথম রোববারে সারা বিশ্বজুড়ে বন্ধু দিবস পালন করা হয়। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না বন্ধু দিবস কিভাবে এলো। ১৯৩৫ সাল থেকেই বন্ধু দিবস পালনের প্রথা চলে আসছে আমেরিকাতে। জানা যায় ১৯৩৫ সালে আমেরিকার সরকার এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। দিনটি ছিল আগস্টের প্রথম শনিবার। তার প্রতিবাদে পরের দিন ওই ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করেন। এরপরই জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদান আরতাদের প্রতি সম্মান জানানোর লক্ষেই আমেরিকান কংগ্রেসে ১৯৩৫ সালে আগস্টের প্রথম রোববারকে বন্ধু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেন। 


আর বর্তমানে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিশ্বের বহু দেশেই। যাদের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী বন্ধু আর বন্ধুতা, তারা একমুহূর্তের জন্যেও মন থেকে আড়াল করতে পারেন না বন্ধুদের। জীবনের সংকটে এরা ছুটে যান বন্ধুদের কাছে। আবার আনন্দ, উল্লাস কিংবা দিন শেষের অবসরেও এরা ভালোবাসেন বন্ধুত্বের কলতান শুনতে। বন্ধুত্বের পরিপূরক সম্পর্কের মাঝে এরা খুঁজে পান জীবন যাপনের ভিন্ন রস। আত্মার কাছাকাছি যে বসবাস করে, সে আত্মার আত্মীয়; বন্ধু বা স্বজন। ‘পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্কটির নাম বন্ধুত্ব’-এরিস্টটলের এই চির সত্য বাক্যটির কথা মনে করিয়ে দিতেই যেন প্রতিবছর ঘুরে ঘুরে আসে বন্ধু দিবস। ‘বন্ধু’ শব্দটা হয়তো ছোট। কিন্তু এর গভীরতা বা ব্যাপ্তি কতটা, তা তখনই বোঝা যায় যখন জীবনে খুঁজে পাওয়া যায় সত্যিকারের একজন বন্ধু। কিন্তু এই ফেসবুক, স্কাইপে, ম্যাসেঞ্জার আর গুগল প্লাসের ভার্চুয়াল যুগে ভুরি ভুরি বন্ধুর ভিড়ে সেই সত্যিকারের বন্ধু খুঁজে পাওয়াটা একটুখানি দুষ্কর।


তবে কাজটা সহজ হতে পারে, যদি আমরা জানতে পারি, বন্ধু আর বন্ধুত্বটা আসলে কী।

বন্ধুত্বকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জার্মান মনস্তত্ববিদ মিশায়েল শেলব্যার্গ বলেছেন, “বন্ধু তাকেই বলা যেতে পারে যে বন্ধুর সুখ-দুঃখের সঙ্গী হবে৷ সেই সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসা থাকবে বটে, কিন্তু সে ভালোবাসা হবে যৌক্তিক, বিশেষ মাত্রার৷ একজন বন্ধুর ওপর আরেকজন নির্ভর করতে পারবে, বিশ্বাস করতে পারবে৷” অনেকে বলে থাকেন, “এই বন্ধু দিবস কি শুধুই এক দিনের জন্য বন্ধুকে স্মরণ করা, কাছে পাওয়া? এর মাঝেই কি বন্ধুত্ব সীমাবদ্ধ?” এর উত্তরে বলা যায়, বন্ধু দিবস হচ্ছে বন্ধুকে বিশেষভাবে স্মরণ করার জন্য। এই বিশেষ সম্পর্ককে সম্মান প্রদর্শনের জন্য। বন্ধুর সঙ্গে দিনটি উপভোগ করার জন্য।


বন্ধু দিবসের সঠিক ইতিহাস নিয়ে রয়েছে অনেক মতভেদ, যীশুখ্রীস্টের জন্মের সময়কার ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়েও পাওয়া গেছে বছরের এমন একটি দিনের কথা, যেদিন বন্ধুর বাড়িতে পাঠানো হতো ঘরে তৈরি সবচেয়ে ভালো পানীয় ও রুটি। খাতা-কলমে দিনটিকে বন্ধু দিবস বলা হতো কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় থাকলেও, শুধু বন্ধুত্ব ও বন্ধুদের কথা মাথায় রেখেই যে দিনটিকে পালন করা হতো, তা নিয়ে সন্দেহ নেই কারো। প্রাচীন লোকগাঁথা, পৌরাণিক কাহিনীতেও পাওয়া যায় বছরে একবার করে পালিত এমন একটি দিনের কথা, যে দিনটি উৎসর্গ করা হতো বন্ধুত্বের স্মরণে। এদিনে বিশেষ প্রার্থনাও করা হতো ভালো বন্ধু পাওয়ার আশায়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, সেই ১৭০০ শতাব্দী থেকে আগস্টের শুরুতে কোনো একদিনে পশ্চিমা দেশগুলোতে পালিত হতো বন্ধু দিবস। তারিখটি যদিও তখন স্থান ভেদে ভিন্ন ছিল। তবে ইতিহাসবিদদের মত অনুযায়ী, গ্রীষ্মের শেষে শীতপ্রধান এ দেশগুলোতে কনকনে ঠাণ্ডা পড়ার আগেই যেন দিনটিকে পালন করে ফেলা যায়, সে কারণেই আগস্টকে বেছে নেয়া হয়। তখন বন্ধুদিবসের উপহার সামগ্রী মূলত সীমাবদ্ধ ছিল ঘরে তৈরি জিনিসের মধ্যেই। কিন্তু ধীরে ধীরে তা পেতে শুরু করল বাণিজ্যক রূপ। মাফলার, হাতমোজা, খাদ্যসামগ্রী, মোমবাতি ইত্যাদি উপহার দিয়ে তখন পালন করা হতো বন্ধুদের জন্য সেই বিশেষ দিনটি।


অন্য অনেক দিবসের মতো বন্ধুদিবস পালনের ক্ষেত্রেও এগিয়ে ছিলো যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন কংগ্রেস ১৯৩৫ সালে রীতিমতো আইন প্রণয়ন করে আগস্ট মাসের প্রথম রোববারকে বিশ্ব বন্ধু দিবস ঘোষণা করে। এ মূল কারণ ছিল, দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় সহিংসতা-সংঘর্ষের বিষকে দমন করা। এরপর থেকেই আগস্ট মাসের প্রথম রোববার বন্ধু দিবস হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দুনিয়াজুড়ে। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধুদিবসের বিপুল সফলতার পর ধারণাটি ইউরোপেও তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। যান্ত্রিক জীবনে যেখানে হয়তো সারা বছরে একবারও দেখা হয় না বন্ধুর সঙ্গে, সেখানে শুধু বন্ধুর জন্য বরাদ্দ একটি দিনের ভাবনা তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।

উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে ভারতে সর্বপ্রথম বন্ধুদিবসের ধারণাটি প্রচার ও প্রসার পায়। অনেকের মতে, মূলত মিডিয়া ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সম্মিলিত প্রয়াসের ফলেই বন্ধু দিবস পৌঁছে যায় উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোতে।


এরই মধ্যে ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র ‘উইনি দ্য পোহ’কে ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাম্বাসেডর অব ফ্রেন্ডশিপ’ মনোনীত করা হয়। ‘পোহ’ হয়ে যায় বিশ্বব্যাপি বন্ধুত্বের প্রতীক বা মাসকট। আর বন্ধু দিবসের থিম সং হিসেবে এই দিনটিতে অনেকেই শোনেন ১৯৬৭ সালে বের হওয়া বিখ্যাত গান ‘উইথ অ্যা লিটল হেল্প ফ্রম মাই ফ্রেন্ড’। উইনি আর বিটলস’র গানের কথা সবাই সেভাবে মনে না রাখলেও বন্ধুকে কার্ড ও ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড উপহার দিয়ে দিনটিকে পালন করতে সমগ্র মানুষ এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, এখন শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়েই নয়, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আর পত্র-পত্রিকাতেও দিনটি পালন করা হয় ঘটা করে। বন্ধুর হাতে বেঁধে দেয়া হয় একটা ব্যান্ড দিয়ে, যা ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড নামেই তা পরিচিত হয়ে উঠেছে। এই বন্ধন যেন বন্ধুত্বের বন্ধনকে আরো পোক্ত করে। বন্ধুর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জর্জ হার্ভার্ট বলেন, “একজন বন্ধু হলো সর্বোৎকৃষ্ট আয়না।” তার মানে, এই আয়নাতে প্রতিমুহূর্তে সে নিজেকে দেখবে। শুধু বাহ্যিক অবয়বকে নয়, ভেতরটাকেও। একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর মন্তব্য, বন্ধুত্বটা হওয়া চাই হাত আর চোখের সম্পর্কের মতো। হাতে ব্যথা লাগলে চোখে জল। আর চোখে যদি জল ঝরে, তবে হাত এগিয়ে যায় তা মুছে দিতে।


তাই এই বন্ধু দিবসে প্রত্যাশা এই যে, নিজের কাছের বন্ধুটির চোখে নিজেকে আবার নতুন করে সৃষ্টি করি। বন্ধুর জন্যই থাকুক এই দিনটি। চলুন, এই একটি দিন পুরানো সেই বন্ধুটিকে গিয়ে বলি, “তোকে অনেক মিস করছি রে। শুভ বন্ধু দিবস।” এরপর দেখুন, বন্ধুর চোখে ছল ছল জলে ভেসে উঠবে শুধু আপনার স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবিটি, যেখানে দেখা যাবে নিঃশর্ত ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, আস্থা আর অগাধ বিশ্বাস। বন্ধু তো সবাই, সুহৃদ কোথায়? আপনার বন্ধুর সংখ্যা ঠিক কত? ফেসবুক প্রোফাইলে দেখা যাবে, সেখানে নিদেনপক্ষে দু’শো মুখের সারি৷ এরা সবাই বন্ধু৷ কিন্তু সত্যিই কি বন্ধু? জার্মান মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, তিনের বেশি বন্ধু সংখ্যা হওয়া অসম্ভব৷ তাহলে ব্যাপারটা আসলে কী? ব্যাপারটা হলো আসলে গুরুচরণ৷ এই ফেসবুকের জগতে মানুষ বড্ড বেশি বন্ধুবৎসল হয়ে উঠেছে৷ কোচবিহারের গণ্ডগ্রাম হোক বা নিউইয়র্ক৷ মিসিসিপির চাষি বা মেদিনীপুরের জোতদার, সবাই এখন এই নেট জগতে ফেসবুকে হাজির৷ চকচকে ঝকঝকে ফেসবুক প্রোফাইলে সবাই বেশ হাসিমুখে কেবল বন্ধু খুঁজে চলেছে৷ এ যেন এক হাওয়ায় ভাসা জগৎ৷ সেখানে আপনার বাবা, মা, ভাই, বোন, পুত্র কন্যা, কেউই নেই৷ সবাই বন্ধু৷ সবাই সুহৃদ৷ কিন্তু এই যে পিতা-পুত্র থেকে ভাই-বোন, সব রক্ত সম্পর্ক মুছে, সব ধরনের আত্মীয়তা ভুলে গিয়ে সবাই বন্ধু, এটা কি সত্যিই সম্ভব?


একজন ভাল বন্ধু মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিংবা সুখ-দুঃখে ভরা মানুষের জীবন। কিন্তু এসবের কোনটাই কখনও স্থায়ী হয় না। তাই কান্না বা দুঃখের পর সুখের দিন আসে। সুখময় দিনগুলো যখন মানুষ শুধু নিজে ভোগ করতে পারে কিংবা সবাইকে নিয়ে উপভোগ করে ঠিক তেমনি দুঃখের দিনেও মানুষ অন্যকে কাছে চায় বা তার সাহায্য কামনা করে।সুখ দূঃখের সাথী যে সেই প্রকৃত বন্ধু। কিন্তু মানুষ মাত্রই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সার্থপর হয়। তাই যতক্ষন নিজের স্বার্থ সিদ্ধি না হয় ততক্ষন পর্যন্ত বন্ধুত্ব এবং সম্পর্ক স্থায়ী হয়। বন্ধু বা আত্মীয় যদি বিপদে পড়ে তখন তার সাথে থাকলে তাকেও বিপদে পড়তে হবে এই ভেবে দীর্ঘ দিনের বন্ধু বা আত্মীয়ও সেই সম্পর্ক নষ্ট করে কেটে পড়ে।


বন্ধুত্ব এমন একটি সম্পর্ক যা কেউই জন্মসূত্রে পান না। নিজের বিবেক বিবেচনা, বুদ্ধি এবং নিজের মতো একজন মানুষ খুঁজে পেলে আপনা-আপনিই বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তবে সব বন্ধুত্বই কিন্তু বুঝে শুনে হয় না। অনেক সময়েই এমন মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায় যারা আমাদের থেকে একেবারেই উল্টো ধরণের। বলতে গেলে তারা থাকেন বন্ধুবেশী শত্রু। তাদের বন্ধুত্ব হয় উপর দিয়ে, ভেতরে কিন্তু তিনি আপনাকে একবারেই বন্ধু ভাবেন না। এই ধরণের মানুষজন অনেকক্ষতিকর। চিনতে চান এই ধরণের বন্ধুদের? তাহলে জেনে নিন কোন ধরণের মানুষের বন্ধুত্ব আপনার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।


আমাদের এ বিচিত্র জীবনে মানুষ অন্যের সঙ্গে আনন্দের অংশীদার হতে চায় কিন্তু দুঃখের বা কষ্টের সময় তারা ঐ মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করে। তাই এই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই স্বার্থপর ও সুযোগ সন্ধানী। স্বার্থ সিদ্ধির আশায় বন্ধুর মুখোশ এঁটে সুসময়ের সঙ্গী হয়। কিন্তু দুঃসময় আসলেই এই বন্ধুই আবার দূরে চলে যায়। প্রকৃতিতে যখন ফুলের মেলা বসে, গাছে গাছে যখন সবুজ পাতার ছড়াছড়ি তখনই কোকিল আসে। শীতের মাঝে এই কোকিলকে আর পাওয়া যায় না। এদেরকে বলে বসন্তের কোকিল। ঠিক এমন সুসময়ের বন্ধু যারা তারাও বসন্তের কোকিলের মতোই সুযোগ সন্ধানী। স্বার্থপর লোকেরা তাই আনন্দময় দিনের ভাগ নিতে আসে কিন্তু দুঃখের দিনে বিদায় নেয়। এ শ্রেণীর বন্ধুরা প্রকৃত বন্ধু নয়। কেননা প্রকৃত বন্ধুরা কখনো বিপদকালে সুসময়ে যার সাথে ছিলো তাকে ত্যাগ করে না। বরং বিপদেই বন্ধুর সাহায্যার্থে পাশে এসে দাঁড়ায়। সত্যিকার বন্ধুর সুসময় বলে কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। সে সব সময়ই বন্ধুর পাশে বন্ধুত্বের মহিমায় চির অম্লান। ভ্রমরের মতো ফুলের মধু শেষ হলেই এর কাজ শেষ হয়ে যায় না। কৃত্রিম বন্ধুত্বের বন্ধনে নিজেকে শুধু স্বার্থ উদ্ধারের আশায় জড়িয়ে রাখে না। বন্ধুর বিপদে নিজের বিপদ মনে করেই তার পাশে থাকে সবসময় এবং সব ধরনের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এরাই প্রকৃত বন্ধু অসময়ে বা অভাবের সময় বন্ধুর কাছে থাকে। সুসময়ে বা প্রাচুর্যের সময় যারা ভীড় জমায় তারা কেউ প্রকৃত বন্ধু নয়।

প্রত্যেক বন্ধুর উচিত বিপদের সময় বন্ধুর পাশে থেকে তাকে সাহায্য করা। এটাই হল সত্যিকার বন্ধুর যথার্থ পরিচয়।

বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবসে বিশ্বের সকল বন্ধুদের জানাই শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।

Post a Comment

0 Comments